deneme bonusu
ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ

* জয় বাংলা * জয় বঙ্গবন্ধু

spot_img
Homeইতিহাসছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ

ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ

ছয় দফাকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ। কারণ, স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল ছয় দফায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির এই সনদ যখন ঘোষণা করেন, তখন আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাও বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো অভিযোগ তুলেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, ছয় দফা ঘোষণার পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সামনে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবেন না। ধ্বংস হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। তাদের ধারণা একেবারে অমূলক ছিল না। ছয় দফার কারণে বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজায় শাসকগোষ্ঠী। চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ। তাদের সে চেষ্টা সফল তো হয়নি হয়েছে উলটো। বাস্তবে ছয় দফা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই সঙ্গে জন্ম হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায় ছয় দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝঁুকি কমানোর জন্য এখানে আধাসামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক এই ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত করে। পরে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ১৩ই মার্চ ছয় দফা এবং এ ব্যাপারে দলের অন্যান্য বিস্তারিত কর্মসূচি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করিয়ে নেন। তখনই ছয় দফা বঙ্গবন্ধুর একক চিন্তা থেকে দলীয় চিন্তায় রূপান্তরিত হয়। ছয় দফার আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালির ভাষার দাবি জাতীয়তাবাদে রূপ নিলেও ছয় দফা ঘোষণার পর ‘জাতীয়তাবাদে’র বিষয়টি একমাত্র স্বাধীনতার এজেন্ডায় পরিণত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝে গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের যে জনসমর্থন তা আর থামানো সম্ভব নয়। তাই তাঁকে জেলে রাখার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। মোনায়েম খান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, যতদিন পূর্ববঙ্গের গভর্নর থাকবেন, ততদিন মুজিবুর রহমানকে জেলে থাকতে হবে। ছয় দফা পেশ করে বঙ্গবন্ধু ঘরে বসে ছিলেন না। তাঁর এই দাবি সাধারণ মানুষকে বোঝাতে দেশজুড়ে সফরে বের হন তিনি। বঙ্গবন্ধু অসংখ্য সভা—সমাবেশ করেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে সমাবেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন ছয় দফার পক্ষে জনমতের সফর। ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে ছয় দফা। সমস্ত বাঙালি জাতির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। শাসনক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন স্বৈরাচার আইয়ুব খান। ছয় দফার বিরুদ্ধে আইয়ুব—মোনায়েমের বিষোদ্গার চলতেই থাকে। তবে বঙ্গবন্ধু দেশজুড়ে তাঁর গণতান্ত্রিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বন্ধ করেননি। পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্রমেই জোরালো হতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দিয়ে ঢাকায় ফেরেন বঙ্গবন্ধু। সে রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবন থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁদের স্থান হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুজিবের নামে মামলা আর বার বার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এ ধরনের হয়রানিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এর মাঝে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ছয় দফার বাস্তবায়ন নীতি অব্যাহত থাকবে। ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করা হবে। এ কর্মসূচি ঘোষণার পর শাসকগোষ্ঠী প্রচার কাজে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের আটকে রাখার কৌশল নেয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ সব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। হরতালকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে। হরতাল কর্মসূচি চলাকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে পুলিশ। তবু আন্দোলন দমাতে পারছে না শাসকগোষ্ঠী। ছয় দফা জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায়। ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনন্য এক স্থান দখল করে আছে। কারাগারের রোজনামচা—তে বঙ্গবন্ধু সে কথা তুলে ধরেছেন এভাবেÑ ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাতে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। বন্দি, সিপাহীরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে গেলাম; বুঝতে বাকি রইলো না আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের নিয়ে আসা হয়েছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য।’ বঙ্গবন্ধু এ সময় কিছু রাজনীতিবিদের মুখোশও খুলে দিয়েছিলেন। ছয় দফা নিয়ে এক প্রবন্ধে তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, এই রাষ্ট্র বাঙালির জন্য তৈরি হয়নি। একদিন বাঙালিকেই বাঙালির ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই তাই এই একজন মানুষ (বঙ্গবন্ধু) তাঁর লক্ষ্যও নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তাঁর সে লক্ষ্য পূরণও হয়। ১৯৬৬ সালে এ ছয় দফা প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু এটি গ্রহণ করার জন্য আতাউর রহমান খানসহ তৎকালীন পূর্ব ও পাকিস্তানের বিরোধী দলের সব নেতার কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে অগ্রসর হলে ফাঁসিতে ঝুলানো হবেÑ এমন ভয় থেকে কোনো নেতাই এগিয়ে আসেননি। তখন বঙ্গবন্ধু নিজেই সিদ্ধান্ত নেন ছয় দফা নিয়ে তিনি জনগণের কাছে যাবেন। এর পরই এ নিয়ে জনজাগরণ সৃষ্টি হয়।’ ছয় দফা ঘোষণার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপএর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এই যে ছয় দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?’ আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব: ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ স্বাধীনতা যেমন একদিনে অর্জিত হয়নি, তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের এ পথ কখনই মসৃণ ছিল না। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল রচনা ও অবলম্বন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে পেঁৗছে দেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। ঐতিহাসিক ছয় দফা তেমনি এক শক্তিশালী সুদূরপ্রসারী কৌশল। ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাঝে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে পেঁৗছায়, সেই কর্মসূচি সম্পর্কে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত প্রগতিবাদী কিছু দলের মনোভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান আর পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শ্রেণির মনোভাবের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ ছিল না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘ছয় দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা—মরার দাবি। এটাকে জোর করে দাবানো যাবে না। দেশের অমঙ্গল হবে, একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। আমাদের শাসকগোষ্ঠীও ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না।’ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ. ১৪২)। বঙ্গবন্ধুর এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপ নিতে লাগে মাত্র পাঁচ বছর। বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফা কর্মসূচি প্রস্তাব করেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল এই কর্মসূচিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী নকশা’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার সমালোচনা ও বিরোধিতা করে। অথচ ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক দেশ, এক অর্থনীতিভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত করা; এবং দ্বিতীয়ত, বাঙালির জন্য চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করাই ছিল ছয় দফার মূল উদ্দেশ্য। মানে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করা। তাই বলা যায়, ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ। যা সত্যিকারেই বাঙালিকে মুক্তি দিয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়নি, দিয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্রও।

শামস সাইদ: কথাসাহিত্যিক

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular